তুলসী গাছ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার সময় বৃন্দাকুন্ড নামে একটি বিশেষ স্থান ছিলো, সেখানে তুলসী মহারানী নিত্য বিরাজমান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বহু লীলাবিলাসের মধ্যমণি ছিলেন তুলসী মহারানী। তুলসী মহারানী এতটাই প্রিয় ভগবানের যে, ভগবান তুলসী পত্র ব্যাতিত কোনো ভোগই গ্রহন করেন না। শাস্ত্রে বলা আছে, কেউ যদি ভগবানের চরণে এক অঞ্জলী জল এবং তুলসী পত্র অর্পণ করেন, ভগবান তাঁর কাছে ঋণী হয়ে যান। তাই আপনারা বেশি বেশি তুলসী সেবা করুন, তুলসী পূজা করুন। পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে মহাদেব নারদমুনিকে সম্বোধন করে বলেন-তুলসী সম্বন্ধীয় পত্র, পুষ্প, ফল, মূল, শাখা, ত্বক, স্কন্ধ এবং মৃত্তিকাদি সমস্তই পবিত্র। যে গৃহে তুলসী-বৃক্ষ অবস্থিত, তার দর্শন-স্পর্শনেই ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিলয়প্রাপ্ত হয়। যে যে গ্রহে, গ্রামে বা বনে তুলসী বৃক্ষ বিরাজ করে, জগৎপতি শ্রীহরি প্রীতচিত্তে সেই সেই ক্ষেত্রে বাস করেন। রাধাকৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া ও সেবিকা তুলসী মহারাণী তথা বৃন্দাদেবী জগজ্জীবের কল্যাণার্থে ভিন্ন ভিন্ন কল্পে ও মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্নভাবে এজগতে আবির্ভূত হন। তাই জগতে তুলসীর আবির্ভাব সম্পর্কে পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। একই তুলসীদেবী কখনো জলন্ধরের পত্নী, কখনো শঙ্খচূড়ের পত্নী, আবার, কখনো বা ধর্মদেবের পত্নী, কখনো ধর্মধ্বজ কন্যা, কখনো চন্দ্রভানু কন্যা, আবার কখনো কেদাররাজের কন্যারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে, এই প্রত্যেক কন্যাই এক বৃন্দাদেবী এবং প্রত্যেক জন্মেই তিনি কৃষ্ণভক্তিপরায়ণা ছিলেন।
অনেকেই বাড়িতে তুলসীগাছ লাগান। নিয়মিত যত্ন নেন। পুজাও করেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কখনও… আপনার বা আপনার পরিবারে কোনও সমস্যা হলে তার প্রথম প্রভাব পড়ে তুলসীগাছের উপর! তখন হাজারো যত্নের পরও তুলসীগাছ শুকিয়ে যেতে থাকে। কেন হয় এমন? জেনে নিন কারণগুলো-জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে তুলসীগাছ শুকিয়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ বুধ গ্রহ। এই গ্রহের রং সবুজ। এবং সমস্ত গাছ (তুলসী-সহ) এই গ্রহের কারক। আবার অনেক সময় অন্য গ্রহের শুভ বা অশুভ ফল বুধ সেই গ্রহের জাতক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এছাড়া, যে কোনও অশুভ প্রভাব সবার আগে বুধ গ্রহ আর তার কারকের উপর পড়ে। সেই অনুসারেও তুলসীগাছ শুকিয়ে যায়। পুরাণ বা শাস্ত্র মতে, তুলসী দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক। আর অশান্তি, দারিদ্র্য-র মতো সমস্যা যে পরিবারে থাকে সেই বাড়িতে লক্ষ্মী থাকেন না। প্রতীক হিসেবে সবার আগে তুলসীগাছ নষ্ট হয়ে যায়। শাস্ত্র মতে, তুলসী গাছ নীরবে একজন ‘বৈদ্য’-র কাজ করে। ডাক্তারবাবু যেমন চিকিৎসা করে আমাদের নিরোগ রাখেন, তুলসীগাছও তেমনি নেগেটিভ এনার্জি সরিয়ে ঘরে পজিটিভ এনার্জি আনতে সাহায্য করে। ঘরের ‘দোষ-ত্রুটি’ মুক্ত করতে গিয়েও অনেক সময় তুলসী শুকিয়ে যায়।
তুলসী অর্থ যার তুলনা নেই। তুলসী গাছ লামিয়াসি পরিবারের অন্তর্গত একটি সুগন্ধী উদ্ভিদ।হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি একটি পবিত্র উদ্ভিদ হিসাবে সমাদৃত। ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণে তুলসীকে ‘সীতাস্বরূপা’, স্কন্দপুরাণে ‘লক্ষীস্বরূপা’, চর্কসংহিতায় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ঋকবেদে ‘কল্যাণী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তুলসী গাছ বাংলাদেশ এবং ভারতে বৈদিক কাল থেকে ফলানো হয়ে আসছে। এটি সাধারণত মন্দিরের আশেপাশে রোপণ করা হয় এবং বেশিরভাগ হিন্দু বাড়িতে পাওয়া যায়। তুলসী গাছের মাপ এবং রঙ ভূগোল, বৃষ্টিপাত এবং গাছের ধরণের ওপর নির্ভর করে। এই তুলসী গাছের বহুবিধ উপকারের জন্য এখন আর হিন্দু বাড়ির মধ্যে এই গাছ সীমাবদ্ধ নাই। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা তাদের বাগানে এই মূল্যবান গাছটি রোপণ করছেন। রান্না থেকে ওষুধ অবধি এর বিস্তৃত ব্যাপ্তি রয়েছে ব্যবহারে। তুলসীর সুগন্ধ এবং তিক্ত স্বাদ সালাদ এবং সসের সাথে খেলে জিভে জল চলে আসে। প্রাচীনকালে তুলসীকে শুদ্ধতার প্রতিক ধরা হত। বিশ্বাস করা হয় যে তুলসী গাছের সামনে গিয়ে এর ঘ্রাণ নিলেই অনেক ধরণের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আধ্যাত্মিক মর্যাদার কারণে তুলসীকে পবিত্র তুলসী বলা হয়ে থাকে। আয়ুর্বেদে, তুলসী পরিচিত বিস্তৃত স্বাস্থপকারিতার প্রদানকারী হিসেবে। তুলসীর জীবাণু-বিরোধী, প্রদাহ-বিরোধী, বাত-বিরোধী, কেমো-প্রতিরোধী, যকৃৎ সুরক্ষাকারী, ডায়বিটিস-বিরোধী, হাঁপানি-বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
তুলসী গাছ পরিবেশে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন সরবরাহ করে, একারণে একে ‘অক্সিজেনের ভাণ্ডার’ বলা হয়। বহু গুণের সমাবেশ গঠেছে এই তুলসী গাছে। ইউএসডিএ জাতীয় পুষ্টিগুণের ডেটাবেস অনুযায়ী, 100গ্রা তুলসীতে যে পুষ্টিগুণ থাকে তা হচ্ছে, পুষ্টিগুণ মুল্য প্রতি 100 গ্রা,জল 92.06 গ্রা,শক্তি 23 কিক্যাল,প্রোটিন 3.15 গ্রা,চর্বি 0.64 গ্রা,কার্বোহাইড্রেট 2.65 গ্রা,ফাইবার 1.6 গ্রা,চিনি 0.30 গ্রা, ক্যালসিয়াম 177 মিগ্রা,লোহা 3.17 মিগ্রা,ম্যাগনেসিয়াম 64 মিগ্রা, ফসফরাস 56 মিগ্রা,পটাসিয়াম 295 মিগ্রা,সোডিয়াম 4 মিগ্রা,জিঙ্ক 0.81 মিগ্রা,ভিটামিন এ 264 µগ্রা,ভিটামিন বি1 0.034 মিগ্রা,ভিটামিন বি2 0.076 মিগ্রা,ভিটামিন বি3 0.902 মিগ্রা,ভিটামিন বি6 0.155 মিগ্রা,ভিটামিন সি 18.0 মিগ্রা,ভিটামিন ই 0.80 মিগ্রা,ভিটামিন কে 414.8 µগ্রা চর্বি/ফ্যাটি অ্যাসিড,পরিপৃক্ত 0.041 গ্রা,একক পরিপৃক্ত 0.088 গ্রা,বহু পরিপৃক্ত 0.389 গ্রা।
তুলসী একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সক্রিয় জৈব যৌগ । এই গুনের কারণে এটি আপনার ত্বক এবং চুলের জন্য দুর্দান্ত। এটি আপনার শরীরকে শুধুমাত্র অক্সিডেটিভ চাপ এবং ক্ষতি থেকেই রক্ষা করে তা নয় এটি আপনার ত্বক এবং চুলের বিন্যাস উন্নত করে। উপরন্তু, এটি সরিয়াসিস, কুষ্ঠ, চর্মরোগের মত বিভিন্ন ত্বকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর। এটি একটি জীবাণু-বিরোধী প্রতিনিধি এবং এটি ত্বকে আঘাত বা পোকার কামড় নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। চুলের প্রসঙ্গ এলে, তুলসীর ব্যবহারে শুধুমাত্র চুল পাকা বিলম্বিত হয় বা চুল পড়া কমায় তা নয়, টাক পড়ার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। সর্দি, কাশি, কৃমি ও বায়ুনাশক এবং মূত্রকর, হজমকারক ও এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় তুলসী পাতা। কফের প্রাধান্যে যেসব রোগ সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে তুলসী বেশ ফলদায়ক। জেনে নেওয়া যাক, তুলসী পাতার নানা গুণ। মাথা ব্যাথা ও শরীর ব্যাথা কমাতে তুলসী খুবই উপকারী। শিশুদের সর্দি-কাশির জন্য তুলসী পাতা মহাষৌধ হলেও যেকোনো বয়সের মানুষই এ থেকে উপকার পেয়ে থাকে।
তুলসীকে নার্ভের টনিক বলা হয় এবং এটা স্মরণশক্তি বাড়ানোর জন্য বেশ উপকারী। এটি শ্বাসনালী থেকে শ্লেষ্মাঘটিত সমস্যা দূর করে। তুলসী পাতা পাকস্থলীর ও কিডনীর স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তুলসী পাতা বেটে সারা মুখে লাগিয়ে রাখলে ত্বক সুন্দর ও মসৃণ হয়। ত্বকের কোনো অংশ পুড়ে গেলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগালে জ্বালা কমবে এবং সেখানে কোনো দাগ থাকবে না ৷ তুলসীর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। এই উপাদানগুলো নার্ভকে শান্ত করে। এছাড়াও তুলসী পাতার রস শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ঠাণ্ডা-কাশি থেকে রক্ষা পেতে তুলসী পাতা ও আদার রসের সঙ্গে একটু মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে ঠাণ্ডা-কাশি ভালো হবে। চোখের সমস্যা দূর করতে রাতে কয়েকটি তুলসী পাতা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ওই পানি দিয়ে সকালবেলা চোখ ধুয়ে ফেলুন। সকালবেলা খালি পেটে তুলসী পাতা চিবিয়ে খেলে মুখের রুচি বাড়বে। তুলসী পাতার রস খেলে দ্রুত জ্বর ভাল হয়। তুলসী পাতা গরম পানিতে সেদ্ধ করে সে পানিতে গড়গড়া করলে মুখ ও গলার রোগজীবাণু মরে, শ্লেষ্মা দূর হয় ও মুখের দুর্গন্ধও দূর হয়। তুলসী চা শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ায়। মাথা ব্যথা ও শরীর ব্যথা কমাতে তুলসী খুবই উপকারী। তাই সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন অন্তত একটি করে তুলসী পাতা খান। আর নিয়মিত তুলসী পাতা পেতে ঘরের বারান্দা একটু আলো বাতাস আসলে সেখানে কিংবা বাড়ির উঠোনে একটি তুলসী গাছ লাগিয়ে দিতে পারেন।
পাকতন্ত্রজনিত রোগের মধ্যে পরে বিরক্তিজনক পেটের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পায়ুর চিড়। এর মধ্যে কিছু অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী এবং তা মলাশয়ের ক্যানসারের মত জটিল সমস্যায় রূপান্তরিত হতে পারে। গবেষণা ইঙ্গিত করে যে তুলসীর পাতায় পাকতন্ত্রজনিত রোগের চিকিৎসার সম্ভাব্যতা রয়েছে। তুলসী থেকে তৈরি পাচন এই রোগ তাড়াতাড়ি সারায় বলে শোনা যায়। তুলসী খিদে বাড়ায়। তুলসীর রেচকের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং পয়ঃপ্রণালী নিয়মিত রাখে। তুলসীপাতার রস ডিসেনট্রি এবং পরিপাক নালীর প্রদাহ (ডিসপেপসিয়া) । একটি প্রাক ক্লিনিকাল গবেষণা জানিয়েছে যে তুলসীর সেবনে অম্বল এবং গ্যাস্ট্রিক আলসার কমে।
চা-পান করতে প্রায় সবাই পছন্দ করেন। চা পানের যাঁদের আসক্তি রয়েছে, তাঁদের অনেকেই দিনে অনন্ত দুই কাপ পান করেন। চা-পানের উপকারিতা রয়েছে। চা শুধু তরতাজাই করেনি, সেই উত্তেজনাপূর্ণ দিনের ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ধরনের চা পান করতে পছন্দ করেন। কেউ ব্ল্যাট টি পছন্দ করেন, আবার কারুর পছন্দ মশালা চা। চা-পান পছন্দ হলে এর সঙ্গে তুলসী পাতা দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। আর এমনটা কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে লাভজনক। তুলসি পাতার চা শরীরে ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সেজন্য রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিদিন তুলসি পাতার চা খেলে উপকার পাওয়া যায় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমিয়ে হূৎপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করার পাশাপাশি তুলসী চা স্তন ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সহায়ক। তুলসী চা লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সকালে সূর্যোদয়ের আগে কিংবা সন্ধায় সূর্যাস্তের পরে, এবং দ্বাদশী তিথিতে কখন ও তুলসীপত্র চয়ন করতে নেই।
আগের কিংবা সকালে তোলা তুলসীপত্র শুকিয়ে গেলেও, তা শ্রীবিগ্রহ অর্চ্চনায় ব্যবহার করা চলে। সকালে ভক্তের উচিত কয়েকটি তুলসী গাছ রাখা। তবে খুব সতর্কতার সাথে এগুলোর যত্ন করতে হবে। কারণ তুলসী কৃষ্ণ প্রেয়সী। তুলসী গাছ গুলো এমন যায়গায় রাখতে হবে যাতে মানুষ অথবা পশু তাঁর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে না পারে, তাঁকে দুমরে মুচরে দিতে না পারে। মঞ্জরী গুলো কচি সময় হাত দিয়ে (নখ দিয়ে নয়) ভেঙ্গে দিলে গাছটি অত্যন্ত সুস্থও সবল ভাবে বেড়ে উঠবে। তাই চলুন আমরা বেশি বেশি তুলসী গাছ রোপণ করি।
ডিখ/আরসি